চকরিয়া অফিস :
নব্যতা সংকটে পড়েছে এক কালের খর¯্রােতা প্রমত্তা মাতামহুরী নদী। এখন নদীর বুকে জেগে উঠেছে চর। মাইলের পর মাইল বালুরচর আর চর। নদীর বুকে চর জেগে উঠায় এখন নব্যতা হ্রাস পেয়েছে। চির চেনা রুপ যৌবন আর লাবণ্যে ভরা এ অঞ্চল তথা চকরিয়ার ভূস্বর্গ খ্যাত মাতামুহুরী নদীর চিরাচরিত স্বভাব পুরোটাই পাল্টে গেছে কালের পরিক্রমায়। মাতামহুরী নদীকে ঘিরে চকরিয়া বাসীর অভিশাপ আর্শিবাদ দুটোই জড়িত। বর্ষায় যেমন এ নদী অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তেমনি শুকনো মওসুমে নদীর প্রকৃতি রোপ লাবণ্যে ভরে উঠে।
আবার বর্ষা মওসুমে নদী দিয়ে প্রবাহিত বন্যায় দু’কুল উপচে গিয়ে যান মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বানের পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ভাঙ্গন তিব্রতর হয়। তখন আতঙ্কে থাকে নদী তীরের মানুষ তাদের ঘরবাড়ী সহায় সম্পত্তি নিয়ে। তবে এসময় তারা আশায় বুক বাধেঁ শুকনো মওসূমের অপেক্ষায়। নদী তীরের কৃষক চাষী ব্যস্ত থাকে কৃষি উৎপাদন করে বর্ষায় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য।
কালের স্বাক্ষী মাতামুহুরী নদীর রয়েছে হাজার বছরের বিরল ইতিহাস। এ নদীকে ঘিরেই এককালে এখানে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সভ্যতা। ইতিহাস থেকে জানা যায় বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে সীমান্তের ওপারে বার্মার আরকান রাজ্যের বিশাল পাহাড়, পর্বতমালা থেকে খর¯্রােতা ও প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি। যা বান্দরবনের আলীকদম উপজেলার পাহাড়ী এলাকা কুরুপপাতা ও পোয়া মহুরী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। পরে ৪টি উপজেলা যথা আলীকদম, লামা, চকরিয়া ও পেকুয়ার মাটি ভেদ করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিরামহীন চলার পথে আলীকদমের ইন্দু, সিন্দু, চকরিয়ার বাইস্যার ছড়া পর্যন্ত ১১৩ টি ছোট বড় খাল ও ছড়া নদীতে মিশে গিয়ে মাতামুহুরীকে করে তোলে চির প্রাণযৌবন। আর এ নদীর তীরকে ঘিরে অত্র অঞ্চলে গড়ে উঠে প্রচীন সমাজ-সভ্যতা। তৎসময়ে লামা-আলীকদমের সাথে চকরিয়ার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ছিল মাতামুহুরী নদীপথ। এককালে এই মাতামুহুরী নদীতে ভেসে চলতো বড় আকারের নৌকা ও সাম্পান। মানুষ একদিন একরাত নৌকায় চড়ে পরবাস খেটে লামা-আলীকদমে পৌঁছত। তখন নদী কেন্দ্রিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মাতামুহুরীর তীরে গড়ে উঠেছিল সাপ্তাহিক বাজার। যেমন চকরিয়ার বদরখালী বাজার, বেতুয়াবাজার, তরছঘাট, পূর্ববড় ভেওলা বাজার, ফইন্না হাট, জালিয়া হাট, আইয়ুব আলী হাট, লামার চিরিঙ্গা বাজার, কোমার পাড়া হাট, মিনি বাজার, মাঝের পাড়ি বাজার, মানিকপুর বাজার, লামা বাজার ও আলী কদম বাজার। সাপ্তাহে দুইদিন এসব হাট বাজার বসত হরদম বেচাকেনা হত। মানুষজন ও ব্যবসায়ীরা নৌকায় করে সওদা নিয়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে যাতায়াত করত। স্থানীয় ও প্রবীন ব্যক্তিরা জানায় এসব হাটে সকালে বেচা কেনা শুরু হত এবং দুপুর গড়াতেই শেষ হয়ে যেত।
কিন্তু সে চিত্র আর নেই। নদীর উজানে অব্যাহত বৃক্ষ নিধন, অবাধে পাথর আহরণ,পাহাড়ী এলাকায় বসতি স্থাপন ও নদীর তীরে তামাক চাষের কারণে মাটি ক্ষয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদীর ভূমি ঢালু উত্তর-পশ্চিমমুখি। তাই এ জনপদের সভ্যতা সৃষ্টিকালীন মাতামুহুরী নদী সর্পিল গতিতে ক্রমশ বয়ে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে মাতামুহুরী নদীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ নদীর পানি যেমন কৃষকের ফসলে শক্তি যোগায় তেমনি নানা প্রজাতির মাছ ধরে জেলেদের জীবন জীবিকার সহায়ক হতো। এক সময় স্থানীয় জেলেরা নৌকায় চড়ে নদীতে জাল ফেলত। সকালে মাছ ধরে বিকেলে বাজারে বিক্রি করে পরিবারের অন্ন যোগাতেন। স্থানীয় ভাষায় বলা হত রাজ জাল। চকরিয়ার সিংহভাগ মাছের চাহিদা মিটতো মাতামহুরী নদীর মাছ দিয়ে। এখন সে নদী জেলেশূন্য। সবই যেন এখন স্মৃতি।
মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, মাতামুহুরী নদীর দু’তীরে দীর্ঘ দু’দশকের ক্ষতিকর তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছের ওপর। তামাক ক্ষেতে অতিমাত্রায় ইউরিয়া সার ও নানা ধরণের কীটনাশক ছিটানো হয়। এসব কীটনাশক পানির সাথে মিশে নদীতে পড়ে। এতে নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে এবং ছোট ছোট মাছ গুলি মরে যাচ্ছে।
চকরিয়ার মাতামহুরী তীরের ইউনিয়ন সুরাজপুর-মানিকপুরের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম জানান এককালের খরস্রোতা মাতামুহুরীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নাব্যতা হ্রাস, তীরবর্তী জমিতে বেপরোয়া তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব পড়েছে মাতামুহুরী নদীতে। এখন আর আগের মতো মাছ ধরা পড়ে না জলের জালে। মৎস্য শূন্য হয়ে পড়ছে। অতীত স্মৃীতি গুলো এখন আর চোখে পড়েনা। যেমন এক কালে নদীতে ছিল গভীরতা। গোসল করতে গেলে সাঁতার কাটাতাম। তখন দেখতে পেতাম শতশত বাশেঁর ভেলা নদী দিয়ে যাচ্ছে। তখন নিমিষেই ভেলায় চড়ে ভাটির দিকে
অনেকদুর চলে যেতাম। তিনি আরো জানান আষাড় শ্রাবণ মাসে যখন বর্ষা আসে তখন মাতামুহুরী অগ্নি মূর্তি ধারণ করত। নদীর দু’কুল উপচিয়ে টইটম্বুর বানের পানির সাথে আসা লাকড়ি ধরার মজাই ছিল আলাদা। আমরা তখন সবাই মিলে নদী তীরে লাকড়ী ধরা উৎসব পালন করতাম।
স্থানীয়দের মতে, তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াও মাতামুহুরীতে মৎস্য সম্পদের বিলুপ্তি ঘটছে একশ্রেণির লোভী মৎস্য শিকারী ও উপজেলা মৎস্য অফিসের দায়িত্বহীনতার কারণে। মৎস্য বিভাগের দায়িত্ব অবহেলার কারণে জেলেরা নদীতে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে। এতে নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠে। বিশেষ করে বিষের কারণে চিংড়ি মাছ মারা পড়ে বেশী।
এছাড়াও নদীর যেখানে একটু গভীরতা আছে সেখানেই জেলেরা জঙ্গল কেটে ঘের তৈরি করে। কিছুদিন পর ঘেরের চারপাশে বিষ দিয়ে একশ্রেণির পাহাড়ি গাছের ফলের রস ছিটিয়ে মাছ আহরণ করা হয়। প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও এ নদীতে মাছ শিকার করা হয়।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ শিবলী মো. নোমান বলেন, মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী এলাকায় তামাক চাষ বন্ধে এ বছর উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নদীর তীরে তামাক চাষ বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া হবে। নদীর তীরে তামাক চাষের কারণে মৎস্য ভান্ডারের ক্ষতির কথাও জানান তিনি। ##
পাঠকের মতামত: